স্যার, আমি সুখ বিক্রি করি!
মিজান সাহেব টেবিলে রাখা ফাইল থেকে লোকটার দিকে মাথা তোলে তাকালেন। লোকটাকে দেখার পর পরই তিনি সামান্য চমকে উঠলেন। অদ্ভুত টাইপের একটা লোক টেবিলের সামনে দাঁড়ানো। লোকটাকে আগ্রহ করে কিছুক্ষণ দেখলেন। দুনিয়ায় যত রঙ আছে মনে হয় তার চেয়েও বেশি রং মিশ্রণ দিয়ে লোকটার পরনের জামাটা তৈরি। গলা থেকে পা পর্যন্ত আপাদমস্ত শরীর ঢাকা আছে সেই গোলাকার পোশাক দিয়ে। পোশাকটা ঢিলে ঢালা। তারপরও বুঝা গেল শরীর হালকা পাতলা। শরীরের তুলনায় মাথাটা অনেক বড়। শুধু বড়ই নয়, অনেক বড়। মাথার চুলগুলো কোঁকড়ানো। তবে তা অনেক বড় নয় ছোট ছোট। চুলের রং সোনালি। চোখের উপর যে ভ্রƒ’টা আছে সেটা অনেক গা’র কাল রঙের। মনে হচ্ছে ভ্রƒ’র উপর আলকাতরা মেখে রেখেছে। তার রং চিক চিক করছে। চোখের চারপাশে হালকা কাল রংয়ের কাজল দিয়া চোখ দুটো সাজানো।
একসময় মিজান সাহেবের মনে হল লোকটা এই জগতের কোন মানুষ নয়। সে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভুলে এই পৃথিবী’র জগতে এসে পড়েছে। তিনি মুহূর্তে আতঙ্কিত হতে লাগলেন। আতঙ্ক থেকে মিজান সাহেব নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন। সামান্য কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে সামলালেন। তারপর বললেন,“কে আপনি?”
“স্যার আমার পরিচয় দিলেও আপনি চিনবেন না।”
“ও আচ্ছা। আপনি যেন কি বিক্রি করেন, বলে বললেন?”
লোকটা রোবটের মত দাঁড়ানো। একেবারে সোজা হয়ে স্থির আছেন। রোবটের মতই বললেন,“স্যার, সুখ। আমি সুখ বিক্রি করি।”
মিজান সাহেব আবার লোকটাকে দেখতে লাগলেন। আশ-পাশে আর কেউ আছে কি-না সেইটা দেখলেন। তারপর বললেন,“বসুন। সামনের চেয়ারটাই বসুন।”
লোকটা বসল না। একটু নরে চরেও উঠল না। মিজান সাহেব আবার বললেন।
“বসুন।”
“না স্যার, ঠিক আছে। দাঁড়িয়ে থাকতে আমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না।”
লোকটাকে মিজান সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলেন,“আপনার নামটা কী?”
“আমার নাম হিমছিম।”
অদ্ভুত নাম। এমন নাম শোনে মিজান সাহেব নিশ্চিত হলেন যে, লোকটা আসলেই অন্যগ্রহের। পৃথিবীতে এমন নাম কেউ রাখবে না।
“আপনার নামটা অনেক চমৎকার।”
“থ্যাংকু স্যার।
“আপনি বসুন। বসলে কথা বলতে সুবিধে হবে।”
“না স্যার। বসব না।
“বসতে কোন অসুবিধে?”
হিমছিম হ্যা সূচক মাথা নাড়ল।
“ঠিক আছে। চা, কফি ওসব কিছু আনাব?”
হিমছিম না সূচক মাথা নাড়ল।
মিজান সাহেব লক্ষ্য করলেন আর মনে মনে আবিষ্কার করলেন,“লোকটা একটু কথা কম বলে।”
২।
[ চলুন একটু পিছনে ফিরে তাকায়। ]
মিজান সাহেবে’র স্ত্রী রুপসী। রুপসী’র দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে সন্তান। বড় ছেলের নাম আবির, তার পর’টার নাম কবির, আর মেয়ে’র নাম রাখা।
মিজান সাহেব স্বভাব একটু নম্র টাইপের। একজন সৎ, ভালো মানুষ হওয়ার জন্য যতটুকু ধৈর্য থাকা প্রয়োজন, তার-চেয়ে অনেক গুণ বেশি ধৈর্য শক্তি আছে মিজান সাহেবে’র। কিন্তু মিজান সাহেবের স্ত্রী রুপসী তার বিপরীতে। তার ধৈর্য শক্তি কম নয় বরং নেই বললেই চলে। ছেলে মেয়ে-গুলো একটাও মিজান সাহেবে’র স্বভাবের দ্বার কাছে নেই। তারাও বদ স্বভাবের।
মিজান সাহেব প্রাইভেট একটা কোম্পানিতে অফিসিয়াল ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেন। সারাদিন অফিসের খাটা-খাটনির পর বাড়িতে এসে শুনতে হয় বউ বাচ্চাদের কিচির-মিচির। বাচ্চারা না হয় অবুঝ, কিন্তু মধ্য বয়সী রুপসী তো আর অবুঝ নয়!
৩।
কয়েকদিন পূর্বের আলামত!
শনিবার দিন রাত নয়টা চল্লিশ মিনিটে মিজান সাহেব অফিসের সকল কর্ম সেরে বাসায় ফিরেন। শুক্রবার অফিস বন্ধ থাকায় শনিবারে কাজ একটু বেশিই জমে থাকে। তাই শনিবার দিনটা যেন একটা দীর্ঘই মনে হয় মিজান সাহেবে’র কাছে। সমস্ত কাজ সেরে তবেই বাসায় ফিরতে হয়। নয়তো পরদিন বসের নানান কথা শুনতে হয়।
কয়দিন ধরে মিজান সাহেবে’র শরীরটাও বেশ ভাল নয়। ভাবছেন কয়দিন ছুটি কাটাবেন। কিন্তু অফিসে কাজ জমে থাকায় ছুটি চাইতেও লজ্জা বোধ করছেন তিনি। তাই অসুস্থ শরীর নিয়েও অফিসের সকল কর্ম সমাধান করে চলেছেন দিনের পর দিন।
শনিবার রাত নয়টা চল্লিশ মিনিটে যখন বাসার দরজার সামনে দাঁড়ালেন। তখন তার হাত-পা কাঁপছিল। হাত তুলে কলিং-বেল যে টিপবেন সে শক্তিটাও পাচ্ছিলেন না। খুব কষ্ট করে ডান হাতটা তোলে কলিং-বেলের সুইচ’টা টিপলেন। তখন ভেতর থেকে দরজা ওপেন করলেন তারই স্ত্রী রুপসী। দরজা খোলে শব্দ করে বলল, “এত দেরি করলা কেন্?”
মিজান সাহেব কোন জবাব দিলেন না। জবাব দেয়ার মত শক্তি তার শরীরে তিনি অনুভব করছেন না। রুপসী’কে এড়িয়ে তিনি ঘরে প্রবেশ করতে চাইলেন।
“দাঁড়াও, দাঁড়াও। বাজার কই? হাতে তো কোন বাজার-টাজার দেখছি না?”
মিজান সাহেব আর চুপ থাকতে পারলেন না। সরল কণ্ঠে বললেন, “দেখ, রুপসী। আমার শরীরটা খুব একটা ভাল না।”
“কি অইছে, আজরাইল মরণের বিম বাজাইতাছে শরীরে!”
মিজান সাহেব মাথা তুলে তাকালেন রুপসী’র দিকে। তার চোখ দুটো ছল-ছল। রুপসী আবার বলল, “যাও। ঘরে ঢুকবা না। বাজার নিয়া ঘরে ফিরবা। [ তার বুকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের দরজা থপাস করে বন্ধ করে দিল রুপসী।
দরজার সামনে কাঁপন-ধরা শরীর নিয়ে সামান্য-ক্ষণ দাঁড়িয়ে বাজারের দিকে ফিরে গেলেন মিজান সাহেব।
মিজান সাহেবের বাসাটা একটু গলির ভিতরের দিকে। আশ-পাশে কোন বাজার নেই। আধ-কিলোমিটার দূরে একটা কাচা বাজার আছে। সেখানে রাত দশটার পর কোন লোক থাকে না। সেখানে সব্জি জাতীয় কিছু পাওয়া যাবে না এত রাতে। তারপরও মিজান সাহেব ছুটছেন সেই সব্জি বাজারের উদ্দেশ্যে।
মিজান সাহেব অফিসে যাওয়ার সময় তার স্ত্রী তাকে কাচা বাজার নিয়ে বাসায় ফেরার কথা বলেছিল। কিন্তু অফিসের কর্ম ব্যস্ততার কারণে তিনি সেটা ভুলে গিয়েছিলেন। তাছাড়া তার শরীরটারও আজ তেমন ভাল নেই।
বাজার থেকে যখন ব্যর্থ হয়ে মিজান সাহেব ফিরে এলেন তখন তার হাতের ঘড়িতে বাজে চার মিনিট কম এগারো‘টা। এসে তিনি দরজার সামনে দাঁড়ালেন। মনে সাহস পাচ্ছেন না তার স্ত্রী রুপসী’কে ডাকার। কারণ তিনি বাজার নিয়ে আসতে পারেন’নি। কয়েকবার কলিং-বেলের কাছে আপন হাতটা তুলে আবার ফিরিয়ে নিলেন। অনেকক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে দরজার বাম-পাশে বসে পড়লেন। আর সেই বসা থেকে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। দরজার পাশে বসে ঘুমিয়ে এমন অনেক রাত কাটিয়েছেন মিজান সাহেব।
৪।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরের দরজা ওপেন করলেন মিজান সাহেবের ছোট ছেলে কবির। ওর বয়স বার। ও ক্লাস সেভেন-এ পড়ে। সে মিজান সাহেব’কে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। তারপর বলল, “সারা-রাত কি এখানেই শুয়েছিলে নাকি?” তুমিও না আব্বু পার!”
মিজান সাহেব চোখ কচলাতে থাকলেন। কোন কথা বললেন না।
“আব্বু যাও। আমার ব্রাশের ঔষধ শেষ। যাও নিয়ে আসো। সাত’টা পনেরো-তে আমার প্রাইভেট আছে। যাওতো...বলে সে মিজান সাহেবকে টেনে সোজা করল। বড় ছেলে আবির এসে বলল,- “আব্বু, আমার পেন শেষ। কয়েকটা পেন নিয়ে এসো।”
মিজান সাহেব অসহায় অবস্থায় কয়েক’টা গলি পর ‘সায়মা কনফেকশনারির দিকে ধীরে ধীরে যেতে লাগলেন।
৫।
[ চলুন মূল গল্পে ফিরে যায়।]
অনেক পিরা-পিরির পর হিমছিম মিজান সাহেবে’র সামনের চেয়ার’টাই বসল। মিজান সাহেবে’র সাথে কথা হল। হিমছিমে’র সাথে হলুদ রঙের একটা বেগ আছে। হিমছিম জানাল সেই বেগে তার খাবার দাবার। সে কারও কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করে না।
“স্যার, আপনি কতদিনের জন্য সুখ কিনতে চান?” হিমছিম বলল।
“কত দিনে জন্য কত টাকা?” মিজান সাহেব জবাব দিলেন।
হিমছিম মিজান সাহেবের কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না। না শোনার মতো করে সে আবার জিজ্ঞেস করল, “স্যার, আমি ঠিক বুঝলাম না।”
“সুখ’টা আমি আপনার কাছ থেকে কিনব কি ভাবে?”
“স্যার, সেটা আপনার উপর নির্ভর করবে। আপনি বেশি সুখ চান নাকি, কম চান!”
“সুখ, কে না চাই?” মিজান সাহেব একটু হাসলেন।
“স্যার, আপনি যদি ১ দিনের জন্য চান তবে ১%। ১ মাসের জন্য ৫%। ১ বৎসরের জন্য ১০%। ১ যুগের জন্য ২৫%। আর সর্ব শেষ যেটা সেটা হল সারা জীবনে’র জন্য চাইলে ৫০% লাগবে।
মিজান সাহেব হিমছিমে’র কথা শোনে অবাক হলেন আর বললেন, “আমি আপনার হিসেবটা ঠিক বুঝলাম না।”
“জি স্যার, আমি পরিষ্কার করে বলছি। আপনি এবার বুঝতে পারবেন নিশ্চয়ই।”
“হুম, বলুন।”
“ধরুন, আপনার আয়ুষ্কাল একশো বছর। আপনি যদি ১ দিনের জন্য সুখ চান তাহলে আপনার আয়ুষ্কাল থেকে ১% তথা এক বছরের আয়ু কর্তন করা হবে। অনুরূপ-ভাবে যদি আপনি সারা জীবনের জন্য সুখী হতে চান তাহা হলে আপনার আয়ুষ্কাল থেকে ৫০% আয়ু কেটে নেয়া হবে। অর্থাৎ আপনি একশো বছরের মধ্যে পঞ্চাশ বছর বেঁচে থাকবেন। স্যার, আমি কি আপনাকে বুঝাতে পেরেছি?”
মিজান সাহেব ঘামতে লাগলেন। শরীরের মধ্যে একটা অস্বস্তি ভাব অনুভব করছেন তিনি। টেবিলে রাখা ‘বসুন্ধরা ফেশিয়াল টিস্যু’ দিয়ে তিনি কপালের ঘাম মুছলেন। তার এই অস্বস্তি’র ব্যাপার’টা হিমছিমে’র কাছে ধরা পড়ে গলে। হিমছিম বলল, “স্যার, আপনি কি অস্বাভাবিক বোধ করছেন?”
মিজান সাহেব নিজেকে সামলালেন। বললেন, “না। আমি ঠিক আছি।”
৬।
মিজান সাহেব হিমছিমে’র কাছ থেকে ১ বছরের আয়ু’র বিনিময়ে ১ দিনের সুখ ক্রয় করলেন। আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরলেন। দরজার কলিং-বেল টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে দরজা ওপেন করে তার স্ত্রী রুপসী তাকে মুসলিম রেওয়াজে সালাম দিলেন,-
“আসসালামু আলাইকুম।”
মিজান সাহেব সালামের জবাব দিলেন, “ওয়ালাইকুম আস-সালাম।”
তারপর রুপসী মিজান সাহেব’কে পা-ছুঁয়ে সালাম করলেন। দাঁড়ালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “হে প্রিয়, স্বামী। কেমন আছেন আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ। অনেক ভালো আছি। তুমি কেন আছো, রুপসী?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আমিও অনেক ভাল। আসুন, ভিতরে আসুন। মিজান সাহেব ভিতরে প্রবেশ করলেন। রুপসী’র হালকা লাল খয়েরি রঙের শাড়ির কাল আঁচলে মিজান সাহেবে’র কপালে লেগে থাকা ঘাম মুছে দিলেন। আর বললে, “ইস্। ঘেমে একেবারে ভিজে গেছে।”
৭।
হিমছিমে’র কাছ থেকে ১ বছরের আয়ুর বিনিময়ে ক্রয় করা ১ দিনটা মিজান সাহেবে’র কাটল তার চল্লিশ বছরের মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ট দিন হিসেবে। মিজান সাহেব ভাবলেন, ‘বড্ড ভুল করে ফেলেছেন তিনি।’ হিমছিমে’র কাছ থেকে এতো অল্প-সুখ ক্রয় করা তার বোকামি হয়েছে। মিজান সাহেব আর একশো বছর বাঁচতে চান না। বরং অসুখে ১ বছর কাটানোর চেয়ে সুখে একদিন কাটানো অনেক ভালো। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, ‘আবার যদি হিমছিমে’র সাথে দেখা হয়, কথা হয়, তবে, ৫০% ভ্যাট দিয়ে তিনি তার সারা-জীবনের সুখ ক্রয় করে নেবেন। অসুখী একশো বছর বাঁচার চাইতে সুখে পঞ্চাশ বছর বেঁচে থাকার নামই সাফল্য জীবন।।